কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামী ফিকাহ প্রথম পর্ব - তাওহীদ ও ঈমান মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আত্তুওয়াইজিরী ১ টি

ইসলাম হলো: একত্ববাদের সাথে একমাত্র আল্লাহর জন্য আত্মসমর্পণ করা, ইবাদতের দ্বারা তাঁর আনুগত্য করা এবং শিরক ও মুশরেকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা।

মানবজাতির ইসলামের প্রয়োজনীয়তা:

মানব জাতির দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ ইসলাম ছাড়া সম্ভব নয়। ইসলাম মানব জাতির জীবনে পানাহার ও আবহাওয়ার চেয়েও বেশি প্রয়োজন। প্রতিটি মানুষ শরীয়তের মুখাপেক্ষী। মানুষের গতি দু’টি অবস্থার মধ্যে আবর্তন-বিবর্তন করে। প্রথমটি হলো: এমন গতি যার মাধ্যমে তার জন্যে লাভজনক জিনিস বয়ে আনে। দ্বিতীয়টি হলো: এমন গতি যার দ্বারা তার জন্যে যা ক্ষতিকর তা প্রতিহত করে। ইসলাম এমন এক আলো যা তার জন্য উপকার ও অপকার সবই বর্ণনা করে দেয়।

দ্বীন ইসলামের তিনটি স্তর রয়েছে তা হলো: ইসলাম, ঈমান ও এহ্সান। প্রতিটি স্তরের আবার কিছু রোকন রয়েছে।


ইসলাম, ঈমান ও এহসানের মধ্যে পার্থক্য:

১. যদি ইসলাম ও ঈমান দু’টি শব্দ একত্রে উল্লেখ হয় তবে ইসলাম শব্দের উদ্দেশ্য হলো: বাহ্যিক কার্যাদি তা হলো পাঁচটি রোকন। আর ঈমান শব্দের উদ্দেশ্য গোপনীয় কার্যাদি তা হলো ছয়টি রোকন। আর যখন ভিন্ন জায়গায় ব্যবহার হবে তখন একটি অপরটির অর্থে ও বিধানে শামিল হবে।

২. এহসানের সীমা-রেখা ঈমানের সীমা-রেখার চাইতে ব্যাপক। আর ঈমানের বেষ্টণী ইসলামের বেষ্টণীর চাইতে ব্যাপক। অতএব, এহসান শব্দটি অর্থের দিক থেকে ব্যাপক; কারণ সে ঈমানকেও শামিল করে। তাইতো কোন বান্দা ততক্ষণ এহসানের স্তরে পৌঁছতে পারবে না যতক্ষণ না তার মধ্যে ঈমান মজবুত হবে। আর এহসান শব্দটির বিশেষ অর্থে মুহসিন তথা এহসানকারী; কেননা এহসানকারীগণ ঈমানদারগণের মধ্যে একটি ছোট দল। অতএব, প্রত্যেক মুহসিন মু‘মিন কিন্তু প্রত্যেক মু‘মিন মুহসিন নয়।

৩. ঈমান ইসলামের চাইতে অর্থের দিক থেকে ব্যাপক; কারণ ঈমান ইসলামকে শামিল করে। যার ফলে কোন বান্দা ঈমানের স্তর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না যতক্ষণ তার মধ্যে ইসলাম দৃঢ়মূল না হয়। আর ঈমান শব্দটি বিশেষ অর্থে মু‘মিন তথা ঈমানদারগণ। কেননা ঈমানদারগণ মুসলিমদের মধ্য হতে একটি ছোট দল, সবাই মু‘মিন নয়। সুতরাং, প্রত্যেক মু‘মিন মুসলিম কিন্তু প্রত্যেক মুসলিম মু‘মিন নয়।

ইসলাম, কুফর ও শিরকের মাঝে পার্থক্য:

ইসলাম: ইসলাম শব্দটির আভিধানিক অর্থ আত্মসমর্পণ করা। আর ইসলামি পরিভাষায় ইসলাম হলো: তাওহীদের  সাথে একমাত্র আল্লাহর জন্য আত্মসমর্পণ করা, ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর আনুগত্য করা এবং শিরক ও মুশরিকদের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করা। অতএব, যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহর জন্য আত্মসমর্পণ করবে সে মুসলিম। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও অন্যের জন্য আত্মসমর্পণ করবে সে মুশরিক। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য আত্মসর্মপণ করবে না সে অহংকারী কাফের।

কুফরি: প্রতিপালক মহান আল্লাহকে সম্পূর্ণভাকে অস্বীকার করাকে বলে।

শিরক: বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর সঙ্গে তাঁর কাজে, নাম ও গুণাবীতে ও বান্দার ইবাদতে অন্য কাউকে শরিক করে তাঁর মর্যাদাকে ছোট করে দেওয়ার নাম।
কুফরি শিরকের চাইতে বেশি মারাত্মক; কারণ শিরকের দ্বারা আল্লাহর শরিক সাব্যস্ত করা হয়। আর কুফরি দ্বারা প্রতিপালককে অস্বীকার করা হয়। তবে একটি অপরটির স্থানে ব্যবহার হয়। আর যখন একই সঙ্গে ব্যবহার হয় তখন ভিন্ন অর্থ দাঁড়ায়। কিন্তু যখন ভিন্ন স্থানে ব্যবহার হয় তখন একটি অপরটির অর্থ ও হুকুম শামিল করে।

সবচেয়ে বড় নেয়ামত:

মানব জাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ইসলাম একটি বিরাট নেয়ামত। আর কুরআনুল কারীম সবচেয়ে মহান কিতাব যা আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর মখলুকাতের মধ্যে মনোনীত ব্যক্তিকে ওয়ারিস বানান। আল্লাহর বাণী:

ثُمَّ اَوۡرَثۡنَا الۡکِتٰبَ الَّذِیۡنَ اصۡطَفَیۡنَا مِنۡ عِبَادِنَا ۚ فَمِنۡهُمۡ ظَالِمٌ لِّنَفۡسِهٖ ۚ وَ مِنۡهُمۡ مُّقۡتَصِدٌ ۚ وَ مِنۡهُمۡ سَابِقٌۢ بِالۡخَیۡرٰتِ بِاِذۡنِ اللّٰهِ ؕ ذٰلِکَ هُوَ الۡفَضۡلُ الۡکَبِیۡرُ ﴿ؕ۳۲﴾

‘‘অতঃপর আমি কিতাবের অধিকারী করেছি তাদেরকে যাদেরকে আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে মনোনীত করেছি। তাদের কেউ কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী, কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী এবং কেউ আল্লাহর নির্দেশক্রমে কল্যাণের পথে এগিয়ে গেছে। এটাই মহা অনুগ্রহ।’’ [সূরা ফাতির:৩২]

আল্লাহ তা‘য়ালা এ উম্মতকে যাদের মহান কিতাবের ওয়ারিস বানিয়েছেন তিনভাবে ভাগ করেছেন: (১) নিজের প্রতি অত্যাচারী। (২) মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী। (৩) কল্যাণের পথে অগ্রগামী।

অতএব, নিজেদের প্রতি জুলুমকারী যে একবার তাঁর রবের আনুগত্য করে আর একবার নাফরমানি করে। সে সৎ আমলের সাথে খারাপ আমল মিলিয়ে ফেলে। আয়াতে এ প্রকারের দ্বারা আল্লাহ আরম্ভ করেছেন যাতে করে সে নিরাশ না হয়ে পড়ে এবং তার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ প্রকাশ করেন। এ ছাড়া এরাই হলো বেশির ভাগ জান্নাতের অধিবাসী।

আর মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী হলো: যে তার প্রতি যে সকল ওয়াজিব তা আদায় করে এবং হারামগুলো ত্যাগ করে।

আর কল্যাণের পথে অগ্রগামী হলো: যে তার প্রতি যে সকল ওয়াজিব তা আদায় করে এবং হারামগুলো ত্যাগ করে। এ ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায়  বেশি বেশি নফল ইবাদতও করে। এ প্রকারের উল্লেখ আয়াতে সর্বশেষ করার কারণ হলো: যাতে করে সে তার আমল নিয়ে আশ্চর্য না হয়, ফলে আমল বরবাদ না হয়ে পড়ে। তা ছাড়া এরাই জান্নাতে প্রবেশের বেশি অধিকারী। আর নিজেদের প্রতি জুলমকারীরা বেশির ভাগ জান্নাতী হলেও সর্বাস্রে প্রবেশকারী হিসাবে সংখ্যা কম। এরা বেশি হওয়ার জন্য তাদের দ্বারা আয়াতে শুরু করা হয়েছে।

আর আল্লাহ তা‘য়ালা প্রত্যেক প্রকারের জন্য জান্নাতে প্রবেশের ওয়াদা করেছেন। যেমন আল্লাহর বাণী:


جَنّٰتُ عَدۡنٍ یَّدۡخُلُوۡنَهَا یُحَلَّوۡنَ فِیۡهَا مِنۡ اَسَاوِرَ مِنۡ ذَهَبٍ وَّ لُؤۡلُؤًا ۚ وَ لِبَاسُهُمۡ فِیۡهَا حَرِیۡرٌ ﴿۳۳﴾

‘‘তারা প্রবেশ করবে বসবাসের জান্নাতে। তথায় তারা স্বর্ণনির্মিত, মোতি খচিত কংকন দ্বারা অলংকৃত হবে। সেখানে তাদের পোশাক হবে রেশমের।’’ [সূরা ফাতির: ৩৩]